সর্বত্রই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্রমবিকাশ। হাতের নাগালেই সবকিছু। এত সুবিধার মাঝে আছে কিছু বিপত্তি ও অসুবিধা। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে বেড়েছে বিশ্বময় সাইবার ক্রাইম। এসব অপরাধ প্রতিরোধে সৃষ্টি হচ্ছে যুগোপযোগী নিত্য নতুন আইন। আমরা এসব আইন সম্পর্কে ক’জন জানি? জানলে সাইবার অপরাধে কি জড়িয়ে যেতাম? গণসচেতনতার সাথে সাথে আমাদেরকেও জানতে হবে সাইবার ক্রাইম কী? এনালগ সিস্টেমের অবসান হয়েছে। ডিজিটাল যুগে পা রেখেছি এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণেই। ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে বিশ্বের ন্যায় এদেশের মানুষও আজ অনেকটা এগিয়ে। ফোরজি ইন্টারনেট সেবা বর্তমান, আপকামিং ফাইভজি। বেড়ে গেছে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যাও। কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে চলছে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার। এ প্রযুক্তির লিগ্যাল ব্যবহার সম্পর্কে অবগত না থাকায় প্রতিনিয়ত মনের অজান্তেই অনেকে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমনকি পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক গ্যাং কালচার, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, আসক্তি এ সবই হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে। বিশেষ করে যুব সমাজ নেশার মতো আসক্ত হয়ে পড়ছে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে। আর এ আসক্ততা থেকে জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। অনেকে প্রযুক্তির অপব্যবহার জেনে শুনেই করছে নিজ স্বার্থে কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে।
সাইবার অপরাধ বা কম্পিউটার অপরাধ এমন একটি অপরাধ যা কম্পিউটার এবং কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং ইন্টারনেট ভিত্তিক অপরাধেই হল সাইবার অপরাধ। লিঙ্গের ভিত্তিতে দেবারতি হালদার ও কে জয়শংকর নারীর প্রতি সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, ইচ্ছাকৃতভাবে মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতির উদ্দেশ্যে নারীর প্রতি অপরাধ।’ যেমন- ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, ইমু, ইনস্টাগ্রাম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে মানহানিকর বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু পোস্ট করলে, ছবি বা ভিডিও আপলোড করলে, কারো নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভ্রান্তমূলক পোস্ট দিলে কিংবা অ্যাকাউন্টে কারো ছবি ব্যবহার করলে, কোনো স্ট্যাটাস দিলে ও শেয়ার বা লাইক দিলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। ইহা ছাড়াও কাউকে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে হুমকি দিলে, অশালীন কোনো ছবি, কার্টুন কিছু পাঠালে কিংবা দেশবিরোধী কোনোকিছু করলে তা সাইবার অপরাধ হবে। আবার ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কারো যোগাযোগ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করলে, ভাইরাস ছড়ালে কিংবা কোনো সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ করলে সাইবার অপরাধ হতে পারে। অনলাইনে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হলেও সাইবার অপরাধ হতে পারে। এ ধরনের অপরাধ একটি জাতির নিরাপত্তা ও আর্থিক স্বাস্থ্য হুমকি হতে পারে। আইনগত বা আইনবহির্ভূতভেবে বিশেষ তথ্যসমূহ বাধাপ্রাপ্ত বা প্রকাশিত হলে গোপনীয়তার লঙ্ঘন ঘটে।
সাইবার অপরাধের বিচার করা হত ২০১৭ সাল পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ দ্বারা। বর্তমানে এ অপরাধের বিচার করা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ দ্বারা। এ আইনের ২১ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হল- কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা ও মদদ দিলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এর সর্ব্বোচ শাস্তি ১৪ বছরের সাজার পাশাপাশি জরিমানা দিতে হবে ৫০ লাখ টাকা।
বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত মামলাগুলোর বিচার করা হয় দেশের আটটি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালগুলো হচ্ছে- ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল, খুলনা সাইবার ট্রাইব্যুনাল, বরিশাল সাইবার ট্রাইব্যুনাল, সিলেট সাইবার ট্রাইব্যুনাল, রংপুর সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ময়মনসিংহ সাইবার ট্রাইব্যুনাল।
সমাজে আজ সাইবার অপরাধের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে যুব সমাজ ইন্টারনেট ব্যবহারে জানা, অজানায় এমন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধ প্রবণতা শীর্ষক সিসিএ ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে ৬৭ দশমিক নয় শতাংশ নারী। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে তারা। এই অপরাধের শিকার নারীর হার ১৬ দশমিক তিন শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। ছবি বিকৃতি করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১ দশমিক দুই শতাংশ। সংঘটিত অপরাধের চেয়ে জরিপে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি। এই অপরাধ দুই দশমিক ২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক মূন্য পাঁচ শতাংশে। একইভাবে থেমে নেই অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির ঘটনা। এই অপরাধ ১৩ দশমিক পাঁচ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
সাইবার ক্রাইমের মধ্যে যুবকদের তুলনায় নারীরাই বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে। ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও ক্রাইম ডিভিশনের প্রাপ্ত তথ্য মতে ২০১৫ সালে দেশব্যাপী সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছিল ছয়শ ৩৮টি, যা পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ২০১৬ সালে উক্ত অভিযোগে মামলা হয়েছিল নয়শ ২৩টি। আবার ২০১৭ সালে এক হাজার ৫৮টি মামলা ও ২০১৮ সালে এক হাজার একশ ৩৬টি এবং ২০১৯ সালে এক হাজার চারশ ৫৬টি মামলা হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে দুইশ ৩২টি, ২০১৬ সালে দুইশ ছয়টি, ২০১৭ সালে দুইশ ৮০টি, ২০১৮ সালে তিনশ ৭০টি এবং ২০১৯ সালে পাঁচশ ৪০টি পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়েছিল। ইহা ছাড়াও এক জরিপে দেখা যায় ফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকির শিকার হচ্ছে ছয় দশমিক ৫১ শতাংশ এবং কপিরাইট লঙ্ঘনের ঘটনা পাঁচ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অনলাইনে কাজ করিয়ে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে এক দশমিক ৪০ শতাংশ।
সাইবার অপরাধ বা ইন্টারনেটভিত্তিক কোনো অভিযোগ থাকলে প্রথমে নিকটস্ত থানায় সাধারণ ডাইরি (জিডি) বা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর সংশ্লিষ্ট ধারায় এজাহার দায়ের করা যায়। সংশ্লিষ্ট থানা মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালে এখতিয়ারাধীন বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালে নালিশী মামলা দায়ের করা যায়। এমনকি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেও (বিটিআরসি) লিখিতভাবে অভিযোগ করা যায়।
আমরা মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। কেউ কি জানি এর আইনগত ব্যবহার বিধি। অধিকাংশরাই ফেসবুক চালানোর সময় বুঝে না বুঝেই কোনো ছবি কিংবা কোনো স্ট্যাটাসে লাইক, কমেন্ট করে বসি। এমনকি কমেন্ট করার সময় নানা প্রকার তর্কে-বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। তা ছাড়া ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন রকম বার্তা আদান-প্রদান করে থাকি কিন্তু এটার যে কতটুকু ব্যবহারবিধি তাও আমাদের জানা নেই। মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে কারো ছবির ব্যাঙ্গচিত্র অংকন, ছবির মাথা কেঁটে ফেলে অন্য একজনের মাথা প্রতিস্থাপন করে কারো হেরাজমেন্ট করা হচ্ছে। এগুলো যারা করে তারা যে কত বছরের সাজার অপরাধ করেছে সেটা কি সে জানে? নিশ্চয়ই অধিকাংশরাই জানে না। আবার কেউ কেউ সচেতন হলেও জানার চেষ্টা করে না। মনে করে কী আর হবে! প্রতিনিয়ত কারো ফেসবুক এ্যাকাউন্ট হ্যাক করছে অনেকে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আবার অনেকে বন্ধু-বান্ধবরা মজা করেও এমনটা করে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফেসবুক, ইউটিউব, ভাইবার, ইনস্ট্রাগ্রাম, ইমো, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে আসক্তে জড়িয়ে পড়ছে। আর এসব আসক্তের মাধ্যমে যোগাযোগ গণমাধ্যমগুলোর অপব্যবহারে একদিকে সময় ব্যায়, অর্থ ব্যায়, এমনকি তাদের জানা-অজানায় হচ্ছে সাইবার অপরাধ। অভিভাবকরা জানতেই পাড়ছে না যে সন্তানরা কীভাবে সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছে। আজকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কাজেই এ যুব সমাজ সহ শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যত নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। এগিয়ে আসতে হবে আমাদের, এগিয়ে আসতে হবে এদেশের অবিভাবক সরকারকেই। জনগন ও সরকারের পূর্ণ সহযোগিতায় একযোগে এ অপরাধকে প্রতিহত করতে হবে। ইতোমধ্যে দেশে এ সাইবার অপরাধ সংক্রান্তে সচেতনেতা বৃদ্ধির লক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন বিভাগ, সংগঠন, এনজিও কাজ করে যাচ্ছে, সেটি পর্যাপ্ত নয়। শুধু সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমেই এ অপরাধ দমানোর চিন্তা করা মোটেও সমীচিন নই বরং এ অপরাধের কুফল সম্পর্কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের, পাবলিক প্লেসে প্রোজেক্টরের মাধ্যমে জনসাধারণের সচেতনেতার প্রচার-প্রসার ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। যুব সমাজকে সাইবার অপরাধের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
লেখকঃ অ্যাড.মো.রায়হান আলী,আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট,খুলনা।